Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
আমাকে সে ডাকত ‘দাঁভাস’ নামে
বিস্তারিত

আমার বয়স এখন ৫৬ বছর। আমার মনে হয়, এখন আমি ‘আমার  ছেলেবেলা’ নামে একটা বই লিখতে পারি বা লেখার সময় হয়েছে। ‘আমার বাল্যবেলা’ নামেও লেখা যায়। ঝোঁকের মাথায় একদিন দু-এক পাতা লিখেও ফেললাম। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, এ তো বড় ভাইয়ের (হুমায়ূন আহমেদ) ছেলেবেলা হয়ে যাচ্ছে! সব ঘটনা যে তাকে কেন্দ্র করেই। তাকে ঘিরেই আমার বাল্যবেলা। কত ঘটনা, কত স্মৃতি!
আমার ছোটবেলায় সে আমাকে ডাকত ‘দাঁভাস’ নামে। এই নামের কী মাজেজা, আমার জানা নেই।
একবার আমি শখ করে ঈদে চোষ পাজামা বানালাম । ঈদের দিন আমার চোষ পাজামা পরা দেখে সে আমার নাম পাল্টে ফেলে ডাকতে লাগল ‘কাঁকড়া বিছা’ নামে। চোষ পাজামা পরার কারণে নাকি আমাকে কাঁকড়া বিছার মতো লাগছে।
অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড সব যেন আমার সঙ্গে। আরেকবার সে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেল তার মুহসীন হলে। আমরা তখন থাকি কুমিল্লায়। উদ্দেশ্য ঢাকা শহর দেখানো। আমি ডাবল ডেকার বাস দেখলাম, রমনা পার্ক দেখলাম ... আমার মনে আছে সেখানেই প্রথম শার্টপ্যান্ট পরা শামীম শিকদারকে দেখলাম, ছফা ভাইকে (আহমেদ ছফা) দেখলাম...

তাঁরা তার রুমে এসেছিলেন কোনো কারণে। কত অভিজ্ঞতা সেবার ঢাকায় এসে। বলাকা হলে একটা সিনেমাও দেখলাম তার সঙ্গে। অসাধারণ ছবি। এখনো চোখে লেগে আছে।

আরেকটু যখন বড় হলাম, তখন একদিন সে বলল, ‘সিগারেট খাবি?’

আমি তো অবাক। আমার মতো ছোট একটা ছেলেকে সিগারেট খেতে বলছে। তবে আমি বুঝে গেলাম, এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো মজা আছে। তখন সেও সিগারেট খায় না। আমাকে বলল, ‘রান্না ঘর থেকে ম্যাচ নিয়ে আয়।’

ম্যাচ নিয়ে বাড়ির পেছনে চলে গেলাম। ভেতরে ভেতরে আমি উত্তেজিত। কী হতে যাচ্ছে, কে জানে। সে এদিক-ওদিক চেয়ে পকেট থেকে দুটো লম্বা সিগারেটের মতোই জিনিস বের করল। পরে দেখি, সিগারেট চকলেট। বাজারে নতুন এসেছে। সিগারেটের মতো মুখে কামড়ে ধরে দুজনেই মিছি মিছি ম্যাচ নিয়ে আগুন জ্বেলে টানতে লাগলাম।  

ছোটবেলায় তাঁকে প্রায়ই চিঠি লিখতাম। সে প্রতিটা চিঠির উত্তরও দিত মজা করে, ছবি এঁকে। সে ভালো ছবি আঁকত। একবার পত্রিকায় বের হলো পৃথিবীতে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। আমার দারুণ চিন্তা হলো, তাহলে আমরা বাঁচব কীভাবে? রাতে এই চিন্তায় আমার ঘুম হয় না। কী করি? তাঁকে ঢাকার হলের ঠিকানায় আমার চিন্তার কথা জানিয়ে চিঠি লিখলাম।

কিছুদিন পরেই উত্তর চলে এল। ছবি দিয়ে ডায়াগ্রাম দিয়ে চিঠি। পৃথিবীর অক্সিজেন যে অফুরন্ত, কখনো শেষ হবার নয়, তার বিশদ ব্যাখ্যা।

তাঁর চিঠি পড়ে আমার জানে যেন পানি এল। সত্যি ... তাকে নিয়ে কত স্মৃতি, কত বেদনা। সে নিজেই তার কোনো এক লেখায় লিখেছিল, ‘স্মৃতি সে বেদনারই হোক বা সুখেরই হোক, তা সব সময়ই বেদনার ...’ 

তাঁর সব স্মৃতিই এখন বেদনার ... কষ্টের। কেউ মারা গেলে সে দেখতে যেত না। তার যুক্তি হচ্ছে, মৃত মানুষের মুখ দেখলে মানুষটা যে মারা গেছে, সেটা মাথায় থেকে যাবে। বরং তাকে দেখলাম না ... তার জীবন্ত মুখটাই মাথায় থাক। হয়তো সে বেঁচেই আছে ... এমন একটা ধারণা।

এক বছর আগে তার নিস্পন্দ মুখটা দেখেছিলাম বারডেমে। নীলচে একটা মুখ। স্থির, চোখ দুটো বোজা। এখনো চোখ বুজলে প্রিয় ভাইটার সেই মুখটা চোখে ভাসে। কিন্তু কই, তার পরও আমার মনে হয় সে আছে, আমাদের সঙ্গেই আছে ... তার প্রাণবন্ত সেই মুখটা ... হয়তো ধানমন্ডিতে তার ফ্ল্যাটেই সে আছে ... নয়তো নুহাশ পল্লীতে ... আর ওখানে না থাকলেই বা কি? আমাদের বুকের অনেক গভীরে সে তো আছেই ... সব সময়ই আছে।

ছবি
ডাউনলোড